-মাহতাব ফারাহী
বাংলাদেশে হিন্দু বা অন্য কোন ধর্মীয় বিষয়ে বা তাদের উৎসব পালনে রাষ্ট্রকে তেমন একটা নাক গলাতে দেখা যায়না। বাধা দেওয়া তো দূরে থাক। বরং পূজা, বড়দিন আসলে রাষ্ট্রের সমস্ত যন্ত্র তড়িৎ সচল হয়ে ওঠে, কিভাবে নির্ভিগ্নে তাদের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সহায়তা করা যায়। দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিটিং হয়, প্রেস ব্রিফিং করা হয়। মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ঘিরে নিরাপত্তার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আইনশৃংখলা বাহিনীকে জর্জরিত করে ফেলে। তাছাড়া যুগ যুগ ধরে হিন্দু, মুসলিম সহ সব ধর্মমতের মানুষ মিলেমিশে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। কোথাও কোন ধর্মীয় সমস্যা নেই। অথচ প্রায়ই কিছু ভারতপ্রেমী দালাল প্রকৃতির মানুষ কথায় কথায় এখানে ওখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অলিক তত্ত্ব প্রচার করে বেড়ায়। যদিও এতে অমাদের কোন সমস্যা নেই। উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ নিন্দাবাদ, আমরা বলিব, লা-শারীক এক আল্লাহ জিন্দবাদ! বরং ওদের প্রপাগান্ডার বৈরী বাতাসের মধ্যেই আমরা হিন্দু মুসলিমরা এখানে সাম্য, মৈত্রী ও একতার পতাকা উড়াবো, যা উড়তেই থাকবে চিরকাল ।
যাক, সে ভিন্ন কথা। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি স্লোগান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে- দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা। স্লোগানটির দিল্লি অংশের গেরুয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গতকাল প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন। তার নাতিদীর্ঘ পোস্টের এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, 'আমি বাংলাদেশে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ভালো থাকার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।'
মোদীজির কথায়ও দেখি দেশের ফলমূল খেয়ে বেড়ে ওঠা প্রতিবেশী দেশ তথা ভারতের দালালদের প্রপাগাণ্ডার ছাপ স্পষ্ট। কই, আমাদের দেশে তো কোন হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা অন্য কোন সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কোন অভিযোগ নেই! অন্তত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত কয়েকমাসের শাসনামলে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেইনি,যে কারণে মোদীজির উদ্বেগ প্রকাশকে জায়েজ মানা যায়! তার এই উদ্বেগ প্রকাশ নিরেট মুসলিম বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ নয় তো? অর্থাৎ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বলার মতো কোন অভিযোগ না পেয়ে তথাকথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের 'ধুয়ো' তোলা? না-কি নিজ দেশের মুসলিমদের প্রতি তিনি যে অন্যায়, অমানবিক আচরণ করছেন তার আবশ্যিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে কি হওয়া উচিত তা কল্পনা করে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মোদীজি?
এই তো গেলো শুক্রবার গোটা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছিলো মুসলিম ওয়াকফ আইন এ্যামেমম্যান্ট বিল পাশ করার প্রতিবাদে। এই আইন পাশ করার মাধ্যমে ভরতে মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোরভাবে আঘাত হানা হয়েছে। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। পূর্বের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী ভারতজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সময় মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, দাতব্য সংস্থা এবং ধর্মীয় উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করার জন্য প্রায় ৫ লাখ চল্লিশ হাজার একর জমির দেখভাল, তত্ত্বাবধান মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিবর্গরাই করতেন। নতুন বিল পাশ করার মাধ্যমে পরিচালনা বোর্ডে কমপক্ষে দুজন হিন্দু ব্যক্তি থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এবং সরকারকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে যে, তারা ইচ্ছে করলে কারণ দেখিয়ে যে কোন ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। অর্থাৎ মুসলিমদের দানকৃত সম্পদ কেবল মুসলিমদের উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত না হয়ে সরকারি তহবিলে জমা হবে। মূলত ভারতে মুসলিম সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল করে রাখার জন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের চিরায়ত পরিকল্পনার অন্যতম জঘন্য পদক্ষেপ এটি।
এভাবে ভারতের বৃহত্তম ধর্মীয়-সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা প্রায়শই সরকার ও হিন্দু-জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা যথাক্রমে ধর্মীয় কাজে বেআইনী বাধা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ, সরাসরি সহিংস আক্রমণ ও হামলার শিকার হয়ে আসছেন। প্রসঙ্গত ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে ভারতে কেবল সহিংস হামলাতেই প্রায় ১০ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে ১৯৬৪ সালে কলকাতার দাঙ্গায় শতাধিক মুসলিম মারা গিয়েছিল, ৪৩৮ জন আহত হয়েছিল।৭০ হাজারেরও বেশি মুসলিম তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
১৯৬৯ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময় অন্তত ৩০ জন মুসলিম প্রাণ হারিয়েছেন।
১৯৭০ এর ভাওয়ান্দি দাঙ্গা ছিল মুসলিম বিরোধী সহিংসতার আরেকটি বড় উদাহরণ, যা ৭ ই মে থেকে ৮ ই মে ভারতের ভিবান্দি, জলগাঁও এবং মাহাদ শহরে সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে মুসলিম মালিকানাধীন সম্পদের ব্যাপক পরিমাণে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছিল। এসব কাজে পুলিশকে সরাসরি জড়িত করা হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে অযোধ্যা বিতর্কের ফলে প্রায় সহস্রাধিক মুসলিম সহিংস হামলায় প্রাণ হারান এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সতর্ক করে শক্তি প্রদর্শন করার জন্য ভিএইচপি নেতাকর্মীদের দ্বারা মিছিল করা নিয়ে যে উত্তেজনা হয়েছিল, তার ফলস্বরূপ এই সহিংস হামলা হয়েছিলো বলে মনে করা হয়।
১৯৯২ সালের মুম্বাই দাঙ্গায় পুলিশ গুলি চালিয়ে ৯০০ মুসলিমকে হত্যা করেছিলো, ২০৩৬ জন আহত এবং হাজার হাজার মুসলিম বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো।
২০০২ সালে গুজরাটে "ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস" হিসাবে পরিচিত হিন্দু উগ্রবাদীরা মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছিল। এই সহিংসতার সময় অল্প বয়সী মেয়েদের যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল, পুড়িয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এই ধর্ষণগুলি তখন ক্ষমতাসীন বিজেপি দ্বারা ক্ষমা করা হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী।
২০১৩ সালে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুজাফফরনগর জেলায় সংঘটিত দাঙ্গার ফলে ৪২ জন মুসলিম নিহত হয়েছিলো এবং ৫০,০০০ এরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
২০২০ সালে দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন নিহত এবং ২০০ জনেরও বেশি গুরুতর আহত হয়েছিলো।
তারপর থেকে এ পর্যন্ত মুসলিমদের উপর হামলা ও শাহাদাতের ঘটনাবলী তো একেবারেই নিকট অতীতের, তাই এখানে উহ্যই থাকলো ।
অতীতের এই আক্রমণগুলোকে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের জেরে ঘটিত ঘটনা বা দাঙ্গা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
তবে, বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পরে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে সাথে আক্রমণগুলো আরও নিয়মতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে এবং বিশেষ করে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্র-অনুমোদিত কার্যক্রমের আকার নিয়েছে।
এছাড়া প্রতিনিয়ত মুসলিমদের বাড়ীঘর ভাঙা, বুলডোজার দিয়ে মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়া, নামাজরত মুসল্লীদের উপর পুলিশের লাথি, লাঠি হামলা, হোলি উৎসবে জোর করে ধার্মিক মুসলিমের শরীরে রং মাখিয়ে হেনস্থা করা সহ অগণন সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা তো চলছেই তথাকথিত উদার, মানবিক নরেন্দ্র মোদীজির শাসনালয়ে।
দু:খ হয়, আবার হাসিও পায়; সেই মোদীজিই কি-না বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন! এ যেন ভূতের মুখে রাম রাম অবস্থা আর কি!
সুতরাং প্রিয় মোদীজি, আগে নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করুন। অবৈধ আইন কানুনের দোহাই দিয়ে মুসলিম নিপীড়ন, নিষ্পেষণ বন্ধ করুন এবং দয়া করে কল্পনাতেও বাংলাদেশে হিন্দু বা মাইনরিটির নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আপনার আরামের ঘুম হারাম করবেন না। এখানে হিন্দু মুসলিম আমরা সবাই ভাই ভাই। যদিও বা আপনার অমূলক চিন্তা, আপনাদের র' এর ক্রিয়াশীলতা প্রায়শই আমাদের মাঝে তফাত সৃষ্টি করে গোল বাঁধাতে সচেষ্ট, তবে ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের হিন্দু ভাইদের আর বুঝতে বাকী নেই, বাংলাদেশে তারা কীভাবে নিরাপদ এবং কতবেশী নিরাপদ।
লেখক: সাংবাদিক, জনবক্তা।
© Mahtab Farahi. All Rights Reserved. Designed by Mahtab Farahi